Image Credit source: IPL Website
কেউ কেউ বেছে নেন বড় মঞ্চ, নিজেকে মেলে ধরার জন্য। হার্দিক পান্ডিয়া যেন তেমনই ক্রিকেটার। নিজের তো ফিরলেনই, আইপিএল ট্রফিও জেতালেন গুজরাত টাইটান্সকে।
অভিষেক সেনগুপ্ত
রাজস্থান রয়্যালস ১৩০-৯ (২০ ওভারে)
গুজরাত টাইটান্স ১৩৩-৩ (১৮.১ ওভারে)
টুকরো টুকরো শব্দবন্ধনী অনেক দিন মনে থেকে যায়। ‘যদি এমন ছোটখাটো ভুল করে, তা হলে আমার সঙ্গে ওর তুলনা ঠিক হবে না’— এখনও হয়তো কানে বাজছে ক্রিকেট মহলের। কপিল দেবের মতো কিংবদন্তি বলেছেন যখন, আলোচনা তো থাকবেই। পাল্টা মন্তব্যও কি ভুলে গিয়েছে বাইশ গজ। প্রশ্ন শুনে ইষৎ গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, ‘আমি কপিল দেব হতে চাই না। আমি আমার মতো।’
হ্যাঁ, তিনি তাঁর মতোই। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর তীব্র বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন। চোট নিয়ে, ফর্ম নিয়ে, দায়বদ্ধতা নিয়ে। আবার একটা আইপিএল ফিরিয়ে দিল হার্দিক পান্ডিয়াকে। এই প্রজন্মে কেন ভারতের সেরা অলরাউন্ডারের তিনি, মোতেরায় আইপিএল ফাইনালে দেখিয়ে দিলেন। যুজবেন্দ্র চাহালের ঘূর্ণিতে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন। তবু বলতে হবে, রাজস্থান রয়্যালসকে হারিয়ে দিলেন একাই। বল হাতে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। ব্যাট হাতে ৩০ বলে ৩৪ করে গেলেন। ২৩ রানে ২ উইকেট হারিয়ে যখন ধুঁকছে গুজরাত টাইটান্স, ফুঁসছে রাজস্থান, ঠিক তখনই দেখালেন, শুধু আইপিএল নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার তিনিই। টিম আইপিএল জিতল, তবু হয়তো আক্ষেপ থেকে যাবে হার্দিকের, উইনিং শটটা নিতে না পারায়। তবে ভারতীয় ক্যাপ্টেন হিসেবে মহেন্দ্র সিং ধোনি, গৌতম গম্ভীর, রোহিত শর্মার পর আইপিএল ট্রফিতে নিজের নাম লিখে ফেললেন হার্দিক।
.@gujarat_titans – The #TATAIPL 2022 Champions! ? ? ? ?
The @hardikpandya7-led unit, in their maiden IPL season, clinch the title on their home ground – the Narendra Modi Stadium, Ahmedabad. ?? @GCAMotera
A round of applause for the spirited @rajasthanroyals! ? ? #GTvRR pic.twitter.com/LfIpmP4m2f
— IndianPremierLeague (@IPL) May 29, 2022
এ বারই প্রথম আইপিএলের দুনিয়ায় পা দিয়েছে গুজরাত টাইটান্স। তারাই কিনা ইতিহাস তৈরি করে ফেলল প্রথম বারই আইপিএল জিতে। ১৩১ রানের লক্ষ্য টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কোনও টার্গেটই নয়। একটা জুটি দাঁড়িয়ে গেলে কিংবা এক দিকে কেউ একরোখা ব্যাটিং করলে যে কোনও সময় পৌঁছে যাওয়া যায়। হার্দিক ব্যাটে-বলে মোহিত করে গেলেন যেমন, তেমনই শুভমন গিল ফাইনালে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে গেলেন। ১৩০-৯ এর পুঁজি নিয়েও কিন্তু শুরুটা ভালোই করেছিল রাজস্থান। প্রসিধ কৃষ্ণা ফেরান বাংলার ঋদ্ধিমান সাহাকে। ট্রেন্ট বোল্ট বাড়ি পাঠান ম্যাথু ওয়েডকে। বোল্টের প্রথম ওভারে চাহাল যদি শুভমনের ক্যাচটা মিস না করতেন, তা হলে অন্য রকম হতে পারত। সেই শুভমন (নট আউট ৪৫) ছয় মেরে ম্যাচ জিতিয়ে গেলেন। উল্টো দিকে ১৯ বলে নট আউট ৩২ করে গেলেন ডেভিড মিলার। ১১ বল বাকি থাকতেই আইপিএল ১৫-র চ্যাম্পিয়ন গুজরাত।
কে বলে কুড়ি-বিশের ক্রিকেট শুধু ব্যাটারদের গল্প শোনায়? মাপা লাইন, নিখুঁত স্পট, পেসের হেরফের, তীক্ষ্ণ বাউন্সার, স্পিনের চমক দিয়েও আস্ত একটা আইপিএল জিতে ফেলা যায় না? যায়, নিশ্চয়ই যায়। উল্টো দিকে আইপিএলের সেরা ব্যাটার থাকলেও যায়। বিনা মেঘে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটানোর আশঙ্কা থাকলেও যায়। শুধু তাদের টিমের নাম গুজরাত টাইটান্স হতে হবে!
গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে বিতর্কের মধ্যে হার্দিক। আইপিএলকে লক্ষ্য করেছিলেন নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। বরোদার ছেলে আরও একবার দেখিয়ে গেলেন, তিনি মন দিয়ে ক্রিকেটটা খেললে অক্টোবরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ফেভারিট হিসেবে নামবে ভারত। নতুন একটা টিম, যারা আইপিএলের দুনিয়ায় প্রথমবার পা দিল, সেই গুজরাতকে আইপিএল ট্রফি যদি ব্যাটার, বোলার হার্দিক জেতান, তা হলে ক্যাপ্টেন হার্দিকও জেতালেন। সঠিক সময়ে বোলিং বদল, নিজেকে বোলিং চেঞ্জে নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও বুদ্ধিমত্তার ছাপ রাখলেন। ফাইনালে নেতা হার্দিকের কাছেই হারল রাজস্থান। রবি শাস্ত্রীর মতো প্রাক্তন কোচ বলে গেলেন, ‘দুরন্ত ক্যাপ্টেন্সি, দুরন্ত বোলিং হার্দিকের। চাপের ম্যাচে ও কতটা কার্যকর ক্রিকেটার, আরও একবার দেখিয়ে গেল।’
যশস্বীকে (২২) ফিরিয়ে সাময়িক ধাক্কাটা দিয়েছিলেন যশ দয়াল। এর পরই হার্দিক ম্যাজিক। সঞ্জুকে (১৪) ফেরান প্রথমে। তারপর তুলে নিলেন বাটলারকে (৩৯)। হেটমেয়ারের মধ্যে দিয়ে যখন ম্যাচে খানিকটা ফেরার চেষ্টা করছে রাজস্থান, স্লোয়ারে ডাগআউটে ফেরালেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারকে। ফাইনালে স্বপ্নের স্পেল করে গেলেন ক্যাপ্টেন হার্দিক। ৪ ওভারে মাত্র ১৭ রান দিয়ে ৩ উইকেট। মাত্র ২টো চার খরচ করেছেন তিনি।
কেন প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সঞ্জু স্যামসন ভারতীয় টিমে পাকা জায়গা করতে পারেননি? রবি-রাতের আইপিএল ফাইনালই উত্তর দিয়ে দিল। বড় ম্যাচের জন্য নিজেকে গুছিয়ে রাখতে হয়। হার্দিক পান্ডিয়ার মতো। কেরালার ছেলে তা আর বুঝতে পারলেন কই? যশস্বী জয়সওয়াল আউট হওয়ার পর যখন উইকেটে এলেন, উল্টো দিকে জস বাটলারের মতো ফর্মে থাকা ব্যাটার। তাঁর উচিত ছিল একটা দিক আঁকড়ে থাকা। সঞ্জুকে দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়, উঠতি ক্রিকেটার হিসেবে যেমন ছিলেন, বাড়তি দায়িত্ব নিতে হত না, ক্যাপ্টেন হওয়ার পরও সেই ভূমিকা ভুলতে পারেননি। না হলে ফাইনালে অন্তত জ্বলে উঠতেন।
বাটলার রোজ সেঞ্চুরি করবেন, তা হয় না। আইপিএলে তাঁর নামের পাশে ৮০০-রও বেশি রান। এই ম্য়াচেও শুরু করেছিলেন সে ভাবেই। ৩৫ বলে ৩৯ করে হার্দিকের বলে খোঁচা দিয়ে ফিরে গেলেন। বাটলারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, দায় নিতে হবে বাকিদের। দেবদত্ত পাড়িক্কাল, সিমরন হেটমেয়াররা কী করলেন? ঘটনা হল, সারা টুর্নামেন্টে বাটলার কার্যত টেনেছেন টিমকে। ফাইনালে এসেও সে ছবি পাল্টাতে পারলেন না। আইপিএল ফাইনালে সবচেয়ে কম রান তোলার রেকর্ড রয়েছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের, ১২৯। তার থেকে ১ রান বেশি করল রাজস্থান।
লড়াই ছিল। জেদ অনেক বেশি ছিল গুজরাত টাইটান্সের। মোতেরায় ১ লক্ষ ৫ হাজার দর্শকের সামনে রশিদ-সামি-ঋদ্ধিদের ভিকট্রি ল্যাপ স্বপ্নের নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল যেন। প্রত্যাবর্তন কিংবা টিমকে আইপিএল জেতানো শুধু নয়, ভারতের বিকল্প নেতা হিসেবে নির্বাচকদের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেললেন হার্দিক পান্ডিয়া!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: রাজস্থান রয়্যালস ১৩০-৯ (বাটলার ৩৯, যশস্বী ২২, রিয়ান ১৫, হার্দিক ৩-১৭, কিশোর ২-২০)। গুজরাত টাইটান্স ১৩৩-৩ (শুভমন নট আউট ৪৫, হার্দিক ৩৪, মিলার নট আউট ৩২, বোল্ট ১-১৪, চাহাল ১-২০)।