গুয়াহাটির ফেড কাপ সেমিফাইনাল জীবনের অন্যতম সেরা ডার্বি


বড় ম্যাচ, শুনলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। এক অদ্ভূত অনুভূতি। কত স্মৃতি ডার্বি (Derby) ঘিরে! সফল ফুটবলার হওয়ার পাশাপাশি বড় ম্যাচ খেলাও ফুটবলারদের স্বপ্ন। শুধু খেললেই হবে না, সফল হতে হবে। এটাও একটা চ্যালেঞ্জ।

গুয়াহাটির ফেড কাপ সেমিফাইনাল জীবনের অন্যতম সেরা ডার্বি

ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস সেই কবে থেকে ময়দানের জার্সি পরে বসে রয়েছে। নতুন শতাব্দীতে পা দিয়েও ময়দান ঘিরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে রয়েছে ইতিহাস। কত গল্প উপহার দিয়েছে এই ময়দান। আরও ভালো করে বলতে গেলে, কলকাতা ডার্বি ঘিরে কত উত্তেজনা, কত উত্তাপ। তিন বছর পর আবার ডার্বি ফিরছে কলকাতায়। সেই চিরকালীন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বির নানা গল্প নিয়েই TV9Bangla -র এই ধারাবাহিক— ডার্বির হারিয়ে যাওয়া গল্প। আজ অতীতে ফিরলেন মেহতাব হোসেন

বড় ম্যাচ, শুনলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। এক অদ্ভূত অনুভূতি। কত স্মৃতি ডার্বি (Derby) ঘিরে! সফল ফুটবলার হওয়ার পাশাপাশি বড় ম্যাচ খেলাও ফুটবলারদের স্বপ্ন। শুধু খেললেই হবে না, সফল হতে হবে। এটাও একটা চ্যালেঞ্জ। সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। বড় ম্যাচে খেলতে না পারলে নিজেকে প্রমাণই করা যায় না। ওই ম্যাচে তাই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। টেনশনের স্রোত শরীরের ধমনী, শিরায় বয়ে যেত। ভয়, টেনশন এগুলো কাটিয়ে জিততে হবে, এটা ছিল আসল চ্যালেঞ্জ। মাঠে আসার আগে শয়ে শয়ে ম্যাটাডোর দেখতাম। লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন পতাকা আর সমর্থকদের গগনভেদী চিৎকার। বড় ম্যাচ জিততেই হবে, সমর্থকদের এই আবদার এখনও কানে বাজে। অনেক মুহূর্ত এই ডার্বি ঘিরে। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি!

দুই প্রধান মিলিয়ে ১৫ বছর খেলেছি। প্রচুর ডার্বি খেলেছি। শুরুর দিকে তো বছরে ৪টে ডার্বি খেলতে হত। কলকাতা লিগ দুই পর্বে হত। জাতীয় লিগে দু’পর্বে। এ ছাড়া আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড কাপ আর ফেডারেশন কাপ তো ছিলই। কোনও কোনও বছরে ৫-৬টা ডার্বিও খেলেছি। বড় ম্যাচ এলেই সেই এক উত্তাপ, এক উন্মাদনা। সমর্থকদের সেই এক আবদার। বন্ধুদের জন্য আবার টিকিটও জোগাড় করতে হত। মাঠে খেলার আগে, মাঠের বাইরেই কত চাপ। ডার্বি শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকে সমর্থকরা ভিড় জমাত ক্লাবে। জিতলে মাথায় তুলে নাচত। পরের দিন প্র্যাক্টিসেও খুশি খুশি ভাব। আর হারলেই সব শেষ। সমর্থকদের সব রাগ এসে পড়ত আমাদের উপর। ওরাও তো এই ডার্বি জেতার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। তাই আমরা না জিততে পারলে, ওদের রাগ হওয়াটা স্বাভাবিকই ছিল।

জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা এখনও ভুলিনি। তখন মোহনবাগানে খেলি। ২০০৩ সাল। আগের দিন রাতে টেনশনে ঘুমোতে পারিনি। জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। আমার বাড়িতে কেউ সে ভাবে ফুটবলই খেলেনি। তাই ডার্বির উন্মাদনা কী, কেউই জানত না। অলোক (মুখোপাধ্যায়) স্যার তখন আমাদের কোচ। প্রতিপক্ষ হিসেবে ইস্টবেঙ্গল খুব শক্তিশালী। দলে শুধু ব্যারেটো আর মার্কোস। জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ হেরে গিয়েছিলাম। ইস্টবেঙ্গলের কাছে ০-৩ হেরেছিলাম। দ্বিতীয় বড় ম্যাচেও জিততে পারিনি। বদলা নিয়েছিলাম আইএফএ শিল্ডে। ফাইনালে টাইব্রেকারে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। চাপের মুহূর্তে পেনাল্টি শুট আউটে গোল করেছিলাম। প্রথম বড় ম্যাচ জয়ের স্বাদ পাওয়া তখনই। ২০০৬ জাতীয় লিগে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোল করি। ওই ম্যাচেও আমরা হেরে গিয়েছিলাম।

গুয়াহাটিতে ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনাল জীবনের অন্যতম সেরা। মোহনবাগান তখন বেশ ভালো দল। ওই ম্যাচে আমরা জিতব, অনেকে ভাবেইনি। দুরপাল্লার শটে করা গোল এখনও আমার কাছে সেরা। আর একটা গোল করেছিল ইয়াকুবু। চ্যাম্পিয়ন হয়ে সে বার কলকাতায় ফিরেছিলাম। ফিলিপ ডি রাইডার তখন কোচ ছিল। আমরা সবাই মিলে টিমগেম থেকে ইস্টবেঙ্গলকে বড় ম্য়াচ আর ফেড কাপ— দুই-ই জিতিয়েছিলাম।

ভালো-খারাপ সব মিলিয়েই মানুষের জীবন। অধিকাংশ বড় ম্যাচই আমার ভালো গিয়েছে। বেশ কয়েকটা ম্যাচে সেরাও হয়েছি। তবে মোহনবাগানের কাছে ৩-৫ গোলে হারের জ্বালা কখনও ভুলব না। তারই বদলা নিয়েছিলাম গুয়াহাটি ফেডারেশন কাপে। আরও একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ে। নবি জোড়া গোল করেছিল। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে যুবভারতীতে টানা ১০ ম্যাচে জয় পাইনি। সবুজ-মেরুন সমর্থকরা সল্টলেক স্টেডিয়ামকে মোহন-ভারতী নামে ডাকতে শুরু করেছিল। সুভাষ ভৌমিক কোচ হয়ে এলেন ইস্টবেঙ্গলের। পুরো দলকে বদলে দিলেন পেপ টক দিয়ে। ২০০৯ সালে আই লিগের ওই ম্যাচে ৩-০ জিতেছিলাম।

অমল স্যার, বাবলুদা, সুভাষদা, রাইডার, মর্গ্যান এরা সবাই বড় ম্যাচে কোনও না কোনও সময় ফ্যাক্টর হয়ে গিয়েছেন। এঁদের ম্যাচ রিডিংই ছিল আলাদা। কাকে কোন পজিশনে খেলাতে হবে, মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতেন। মর্গ্যানের আমলে কেরিয়ারের সেরা ফর্মে ছিলাম। সেই সময় বেশ কয়েকটা ডার্বিতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হই। ২০১৩-র ডার্বিই বা ভুলি কি করে! টোলগে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে চলে গিয়েছে। ও দিকে তখন টোলগের সঙ্গে আবার ওডাফা। মর্গ্যান আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কলকাতা লিগের শেষ ম্যাচ। আগেই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছিলাম। তাও ৩-২ গোলে ওই ডার্বি জিতে মর্গ্যানকে উপহার দিয়েছিলাম।

২০১৪ সালে আই লিগের ফিরতি পর্বের বড় ম্যাচ। কলকাতা লিগে মোহনবাগানের কাছে হেরে যাই। ড্রেসিংরুমে এসে নীতুদা আমাকে বলল, ‘তুই কত বড় ফুটবলার আজ দেখব।’ আমাকে তাতিয়ে দিল ওই কথাটা। মোহনবাগানকে হারাতে না পারলেও, ১-১ ড্র করেছিলাম। ওই বড় ম্যাচটাও আমার কাছে অন্যতম সেরা।

বড় ম্যাচের চাপ যে নিতে পারবে, সেই বড় ফুটবলার হতে পারবে। দর্শকরা চিরকাল মনে রেখে দেবে তার খেলা। বাঙালিদের কাছে বাড়তি তাগিদ থাকে এই ম্যাচ ঘিরে। কারণ, এই ডার্বি দেখেই তো সবাই বড় হয়। ভয় থাকবেই। সেটাকে জয় করতে হবে। তাহলেই তো তুমি বড় ম্যাচের হিরো হয়ে উঠবে। আজ এত বছর পরও, ডার্বির কথা শুনলে আলাদা উত্তেজনা তৈরি হয়।

এই খবরটিও পড়ুন



(কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন)

Leave a Reply