কার নির্দেশে চার দলীয় সুব্রত কাপ? চরম বিতর্কে মুখ পুড়ল রাজ্য সরকারের


করোনা কাটিয়ে আইপিএল, আইএসএল, ডুরান্ড কাপ হচ্ছে। এত কিছু হচ্ছে, অথচ সুব্রত কাপ করা গেল না!

Image Credit source: TWITTER


দীপঙ্কর ঘোষাল

এক সময় যেখান থেকে উঠে এসেছে অসংখ্য তারকা ফুটবলার, ভারতীয় ফুটবলের আঁতুরঘর যে টুর্নামেন্টকে, সেই সুব্রত কাপ (Subroto Cup) নিয়েই মুখ পুড়ল বাংলার! ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ অক্টোবর দিল্লিতে হবে দেশের সেরা স্কুল ফুটবল (School Football) টুর্নামেন্টের মূলপর্ব। টিমের নাম নথিভুক্তকরণের শেষ দিন ছিল ৭ অগস্ট। সেই সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার দু’সপ্তাহ পর ঘুম ভাঙল রাজ্যের স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের (WB Education Department)। তড়িঘড়ি সুব্রত কাপের মূলপর্বে বাংলার স্কুল টিম ঢোকাতে গিয়ে ‘বাঁকাপথ’ বাছতে হল কর্তাদের। এই রাজ্যে সুব্রত কাপের প্রাথমিক পর্ব আয়োজন না করেই ‘চুপিসাড়ে’ বেছে নেওয়া হল ছেলে ও মেয়েদের বয়সভিত্তিক তিনটে টিম। যা নিয়ে তীব্র হইচই পড়ে গিয়েছে ফুটবল মহলে। অনেকেই কাঠগড়ায় তুলছেন রাজ্য সরকারের স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের কর্তাদের। কোন অজুহাতে তাঁরা সুব্রত কাপের মতো ঐতিহ্যশালী টুর্নামেন্ট নিয়ে এমন ছেলেখেলা করলেন? তদন্তে নেমে টিভি নাইন তুলে আনল বিস্ফোরক সব তথ্য।

 

সুব্রত কাপ নিয়ে এত ঢাকঢাক গুরুগুরু কেন? নিজেদের পিঠ বাঁচাতে স্কুল অব ফিজিক্যাল এডুকেশনের এই লুকোচুরির রাস্তায় হাঁটা। নাম নথিভুক্তকরণের সময়সীমা যখন কার্যত শেষ হয়ে এসেছে, হঠাৎই ঘুম ভাঙে বাংলার আয়োজকদের। তাও হয়তো ভাঙত না। যদি না সুব্রত কাপের মূল উদ্যোক্তা সেনাবাহিনীর তরফে খোঁজখবর শুরু হত। ডুরান্ড কাপ যারা আয়োজন করে, সেই আর্মির তরফেই খোঁজ করা হয়, কেন বাংলা থেকে কোনও টিমের নাম নথিভুক্ত হয়নি? দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলো ততদিনে সুব্রত কাপের রাজ্যভিত্তিক পর্ব শেষ করে চ্যাম্পিয়ন টিমের তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছে। নাম নথিভুক্তও করে ফেলেছে। সুব্রত কাপের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ঢুকলেই তা নজরে পড়বে। বাংলার তরফে কোনও উদ্যোগ না দেখে মূলপর্বের আয়োজকরা বাংলার স্কুল টিম ছাড়াই ২৭টা টিমের নামও ঘোষণা করে দেয়। তখনই টনক নড়ে বাংলার স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের। যোগাযোগ করা হয় আর্মির সঙ্গে। নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিয়ে দ্রুত বাংলার স্কুল টিম পাঠানোর প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। আর করতে গিয়েই মুখ পুড়ল স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের কর্তাদের। লুকিয়ে-চুরিয়ে ছেলে-মেয়েদের চারটে করে স্কুল টিম নিয়ে সুব্রত কাপের মূলপর্ব আয়োজন করতে গিয়ে চরম বিতর্কে পড়ে গিয়েছেন তাঁরা।

SCHEDULE

 

করোনার আগের বছর, ২০১৯ সালে শেষবার নিয়ম মেনে পূর্ণাঙ্গ সুব্রত কাপ হয়েছিল বাংলায়। মহকুমা, জেলা স্তর পেরিয়ে কলকাতায় আয়োজিত হয়েছিল বাংলা ভিত্তিক মূলপর্ব। তিন বছর পর সম্মান বাঁচাতে গিয়ে সেই তিন বছর আগের সুব্রত কাপে ফিরল রাজ্য স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন। ২০১৯ সালে সুব্রত কাপের মূলপর্বের সেমিফাইনাল খেলা চারটে করে মোট ১২টা স্কুল টিমের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করা হয়। সে বার ছেলেদের অনূর্ধ্ব ১৭ বিভাগে সেমিফাইনালে উঠেছিল চারটে স্কুল টিম— হাওড়ার গঙ্গাধরপুর বিদ্যামন্দির, হাওড়ার মাকড়দা বামাসুন্দরী ইন্সটিটিউশন, দক্ষিণ কলকাতার চৌবাঘা হাইস্কুল ও পশ্চিম মেদেনীপুরের খালসা ইন্দুমতী হাইস্কুল। এ ছাড়াও মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৭ বিভাগে মালদার হরিমতী হাইস্কুল, দক্ষিণ দিনাজপুরের সরলা হাইস্কুল, জলপাইগুড়ির খরিজা বেরুবারি হাইস্কুল, পুরুলিয়ার কুঞ্চিয়া হাইস্কুলও ডাক পেয়েছে। রয়েছে অনূর্ধ্ব ১৪ ছেলেদের বিভাগে আরও চারটে স্কুল। বিতর্ক দেখা দিতে পারে, এই ধারনা আগে থেকেই ছিল রাজ্যের স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের। তাই এই স্কুলের ফুটবলারদের মেডিক্যালও সারা হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। একই ভাবে রাজারহাটের এনকেডিএ স্টেডিয়ামে চুপিসাড়ে শুক্র ও শনিবার রয়েছে মূলপর্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়া। শুক্রবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বৃষ্টির মধ্যেই চলছে বাংলার সুব্রত কাপের মূলপর্ব। যা শুনে অনেকেই এর নাম দিয়েছেন ‘ছেলেখেলা’।

কেমন এমন হল? কার নির্দেশে সুব্রত কাপ নিয়ে ছেলেখেলা হল? সরকারি বিষয় বলে কেউই এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ। উত্তর ২৪ পরগনা ডিস্ট্রিক্স কাউন্সিল অফ স্কুল গেমস অ্যান্ড স্পোর্টসের এক কর্তা সরাসরি অভিযোগ করলেন, ‘আমার জেলার স্কুলগুলোকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সুব্রত কাপের সংগঠকরা অনলাইনে এন্ট্রির জন্য যখন বিজ্ঞপ্তি দেয়, আমার জেলার বিভিন্ন স্কুল ২ হাজার টাকা দিয়ে নাম এন্ট্রিও করেছিল। যেহেতু খেলাধুলার কোনও সার্কুলার নেই, জেলার অনেক স্কুলই নিজে থেকে এন্ট্রি করেছিল। সেই স্কুলগুলো তো খেলতে পারল না। অন্যান্য জেলার কথা বলতে পারব না, আমাদের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিকে মিটিংয়ে ডাকা হলেও সকলে আসেনি। মিটিংয়ের কয়েক দিন আগেই শিক্ষা দফতরের ডেপুটি সেক্রেটারির লেটার হেডে একটা সার্কুলার জারি করা হয়েছে। তাতে লেখা, ২০১৯ সালে যে দলগুলো সেমিফাইনাল খেলছিল, সেই দলগুলিকে নিয়ে একটা টুর্নামেন্ট হবে। সেখান থেকে দল পাঠানো হবে দিল্লিতে। সিদ্ধান্তটা পুরোপুরি শিক্ষা দফতরের ফিজিক্যাল এডুকেশনের জয়েন্ট সেক্রেটারির। এখানে জেলা স্পোর্টস কাউন্সিলের কোনও ভূমিকা নেই। আর সবার মতো আমরাও অন্ধকারে।’ সার্কুলারে বলা হয়েছে, কোভিড পরবর্তী সময়ের জন্য রাজ্য জুড়ে টুর্নামেন্ট করা গেল না। করোনা কাটিয়ে আইপিএল, আইএসএল, ডুরান্ড কাপ হচ্ছে। এত কিছু হচ্ছে, অথচ সুব্রত কাপ করা গেল না!

CIRCULAR

 

টিভি নাইন বাংলার তরফে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল স্কুল গেমসের আধিকারিক সুকান্ত বসুর সঙ্গে। বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এসএমএসেরও উত্তর দেননি। যে স্কুলগুলিকে সার্কুলার পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে উত্তরবঙ্গের একটি স্কুলও। নাম লেখা যাবে না, এই শর্তে ওই স্কুলের এক শিক্ষক জানালেন, ‘গত ১২ অগস্ট আমাদের কাছে একটি সার্কুলার আসে। দ্রুত দল গোছানোর চেষ্টা করি। মাঝে ছুটি, খেলা হবে দিবসও ছিল। দল প্রস্তুত করলেও ট্রেনের টিকিট পাইনি। ফলে কলকাতায় খেলতে যাওয়া হয়নি। এত কম সময়ের মধ্যে সবটা গুছিয়ে উঠতে পারিনি।’

উত্তরবঙ্গের ওই স্কুল গুছিয়ে উঠতে না পারলেও স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন সব দিক চমৎকার গুছিয়েই নেমেছিল চার দলের সুব্রত কাপ আয়োজন করতে। অসংখ্য স্কুলকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, তা কি ভেবে দেখেছেন স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের কর্তারা? নিশ্চিত ভাবে না। তাঁরা চেয়েছিলেন নিজেদের মুখ বাঁচাতে। তা করতে গিয়ে যে মুখ পুড়ল বাংলার, তাতে আর কী যায় আসে!

Leave a Reply