যে ক্রিকেটার স্পট ফিক্সিং কিংবা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে জড়িত হয়ে যায়, তাঁর ওপর দিয়ে রীতিমতে ঝড় ঝাপটা বয়ে যায়। তদন্ত, নির্বাসন, বিতর্ক সব মিলিয়ে অন্ধকারের দিকে পাড়ি দেয় তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার।
বিতর্কের ক্রিকেট : ক্রিকেটের বিতর্ক
আলো আর অন্ধকার, দুই-ই পা মেলায় ইতিহাসের মিছিলে। উজ্জ্বলতম অতীত যেমন ফিরে আসে স্মৃতিতে, তেমনই চুপিসারে হানা দেয় কলঙ্কও। ক্রিকেট ইতিহাস যেমন রেকর্ড, সাফল্য, নায়কদের খোঁজ দেয়, তুলে ধরে বিতর্কিত ঘটনাও। ক্রিকেট ইতিহাসের মহাবিতর্কিত নানা গল্পের খোঁজ দিল TV9 Bangla। সঙ্ঘমিত্রা চক্রবর্তী তুলে ধরলেন অষ্টম কিস্তি।
স্পট ফিক্সিং, ম্যাচ ফিক্সিং এ সব তো আর ভুল করে হয় না। এই সবের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে নীতির জলাঞ্জলি দিয়ে, অর্থের বিনিময়ে দল, সতীর্থ এবং সর্বোপরি দেশের সঙ্গে বেইমানি করা হয়। একাধিকবার ক্রিকেট বিশ্ব ম্যাচ গড়াপেটার কারণে তোলপাড় হয়েছে। বুকিদের দাপটে বার বার কালিমালিপ্ত হয়েছে ক্রিকেট। যে ক্রিকেটার স্পট ফিক্সিং কিংবা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে জড়িত হয়ে যায়, তাঁর ওপর দিয়ে রীতিমতে ঝড় ঝাপটা বয়ে যায়। তদন্ত, নির্বাসন, বিতর্ক সব মিলিয়ে অন্ধকারের দিকে পাড়ি দেয় তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার। তেমনই এক বিতর্কিত অধ্যায় ১৯৯৪-৯৫ সালের ‘জন দ্য বুকমেকার।’
ইচ্ছাকৃতভাবে যে বুকিদের কাছ থেকে ক্রিকেটাররা টাকা নেয়, সেই সকল বুকিদের নাম সচরাচর প্রকাশ্যে আসে না। পরে সেই ক্রিকেটার ধরা পড়লে অনেক সময় বুকিদের নাম জানা যায়। সৎ ক্রিকেটাররা কিন্তু উল্টো পথে হাঁটেন। একাধিক ক্রিকেটারদের কাছে জুয়াড়ি, বুকিদের ফোন আসে। কখনও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তো কখনও বা বিলাসবহুল ব্যবস্থায় বিদেশ ভ্রমণ করানোর বিনিময়ে ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিং করার প্রস্তাবও আসে। অনেকেই এই বুকিদের খপ্পরে পড়ে যান। আবার অনেক ক্রিকেটার তাতে সাড়া দেন না। যোগাযোগ করেন, দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে এবং অনেক সময় আইসিসির সঙ্গেও। ৯০ এর দশকে দুই অজি তারকাকে টাকা দিয়ে খবরের শিরোনামে চলে এসেছিলেন এক ভারতীয় বুকি। ১৯৯৪-৯৫ সালের ঘটনা। সেই সময় শ্রীলঙ্কা সফরে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। আর বুকির খপ্পরে পড়ে গিয়েছিলেন মার্ক ওয়া ও শেন ওয়ার্ন।
লঙ্কানদের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচের আগে পিচ ও আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য জানার জন্য ওই ভারতীয় বুকি টাকা দিয়েছিলেন দুই অজি তারকাকে। জানা গিয়েছিল, সেই বুকির নাম জন। শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে কলম্বোয় ওবেরয় হোটেলে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়া দল। সেই হোটেলের কাছাকাছি একটি ক্যাসিনো ছিল। সেই ক্যাসিনোতে যেতেন মার্ক ওয়া (Mark Waugh) ও শেন ওয়ার্ন (Shane Warne)। ওই ক্যাসিনোটিতে ওয়ার্নকে যেতে বারণ করেছিলেন অজি টিম ম্য়ানেজার কলিন এগার। কিন্তু তাঁর কথার তোয়াক্কা না করেই ক্যাসিনোতে যান ওয়ার্ন ও ওয়া। জুয়ার প্রতি টান ছিল ওয়ার্নের। ফলে তিনি সেই ক্যাসিনোতে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারেননি ওয়ার্ন।
ওই ক্যাসিনোতেই মার্ক ওয়ার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ এক ভারতীয় ব্যক্তির। যিনি নিজের নাম বলেন, জন। তিনি জানান, তিনি ক্রিকেটে বাজি ধরে টাকা জিতেছেন। এবং ওয়াকে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে হতে চলা ম্যাচের পিচ ও আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য দিতে বলেন। যার বিনিময়ে তিনি মার্ক ওয়াকে ৪ হাজার মার্কিন ডলার অর্থও দেন। জন একইসঙ্গে অস্ট্রেলিয়া দলের কৌশল, একাদশের ব্যপারেও জিজ্ঞাসা করেন মার্ককে। ওয়া অর্থের বিনিময়ে পিচ ও আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য দিতে রাজি হয়েছিলেন। তবে দলের কৌশল ও প্লেয়ারদের ব্যাপারে জানাতে চাননি।
মার্ক ওয়া এর কয়েকদিন পরেই শেন ওয়ার্নকে ওই বুকি জনের সঙ্গে দেখা করার জন্য রাজি করিয়ে নেয়। তিনজন সেই টিম হোটেলের কাছের ক্যাসিনোতে দেখা করে। জন সেই সময় নিজেকে একজন জুয়াড়ি বলে পরিচয় দিয়ে শেন ওয়ার্নের সঙ্গে ভাব জমায়। তার পরের দিনই ওয়ার্নকে জন তার হোটেলে আমন্ত্রণ জানায়। এবং জন জানায় সে ওয়ার্নের একজন বড় ভক্ত। জন ওয়ার্নের খেলার প্রশংসা করে ৫ হাজার মার্কিন ডলার উপহার দেন। পরবর্তীকালে ওয়ার্ন দাবি করেছিলেন, তিনি প্রথমে সেই উপহার ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জন তাঁকে জোর করায় শেষ মেশ তিনি তা নেন। শুধু তাই নয়, ওয়ার্ন দাবি করেন, তিনি পরে ওই টাকা ক্যাসিনোতে নষ্টও করে ফেলেছিলেন।
এই ঘটনার কথা মার্ক ওয়া ও শেন ওয়ার্ন তাঁদের টিমের অন্য খেলোয়াড়কে জানাননি। তাঁদের বক্তব্য ছিল, তাঁরা ব্যাপারটির মধ্যে কোনও কারচুপি দেখতে পাননি। মার্ক ওয়া যেমন বলেছিলেন, পিচ ও আবহাওয়ার ব্যপারে তো ম্যাচের আগে প্রেস কনফারেন্সেও আলোচনা হয়। যার ফলে তিনি তাতে কোনও ভুল দেখতে পাননি।
দু’জনই ১৯৯৪-৯৫ মরসুমে অস্ট্রেলিয়ার গ্রীষ্মের সময় জনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। যখন ইংল্যান্ড পাঁচ টেস্টের জন্য অস্ট্রেলিয়া সফরে এসেছিল, তখন ওয়ার্ন তিনবার জনের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। মার্ক ওয়াকে ১৯৯৪ সালে তাঁর একজন সিনিয়র খেলোয়াড় এই বিষয়ে সতর্কও করেন। তাঁকে তিনি বুঝিয়েছিলেন, যে ম্যাচ কন্ডিশন, গেম এবং দল সম্পর্কে টেলিফোনে তথ্য প্রদান করাটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ এটি তাঁর কেরিয়ারে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু ওয়া শোনেননি তাঁর কথা।
পরবর্তীকালে এই ঘটনা জনসমক্ষে চলে আসে। তবে এর পরিণতি খুব মারাত্মক হয়নি। ১৯৯৮ সালে শেন ওয়ার্ন ও মার্ক ওয়াকে জরিমানা করেছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড। যদিও এই ঘটনা ঠিক ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো ছিল না। তবুও, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করা যেহেতু অনৈতিক, তাই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড তাঁদের জরিমানা করেছিল। উল্লেখ্য, এসিবি ওয়ার্ন বা মার্ক ওয়াকে নির্বাসিত করেনি।