শুধু ডার্বি কেন, যে ম্যাচেই মাঠে নামতাম, সেটা আমার জীবনের শেষ ম্যাচ ভেবেই মাঠে নামতাম।
Image Credit source: OWN Photograph
ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস সেই কবে থেকে ময়দানের জার্সি পরে বসে রয়েছে। নতুন শতাব্দীতে পা দিয়েও ময়দান ঘিরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে রয়েছে ইতিহাস। কত গল্প উপহার দিয়েছে এই ময়দান। আরও ভালো করে বলতে গেলে, কলকাতা ডার্বি ঘিরে কত উত্তেজনা, কত উত্তাপ। তিন বছর পর আবার ডার্বি (Kolkata Derby) ফিরছে কলকাতায়। সেই চিরকালীন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান (East Bengal vs Mohun Bagan) ডার্বির নানা গল্প নিয়েই TV9 Bangla -র এই ধারাবাহিক— ডার্বির হারিয়ে যাওয়া গল্প। আজ অতীতে ফিরলেন দেবজিৎ ঘোষ।
তিন বছর পর আবার কলকাতায় বড় ম্যাচ ফিরছে। ছবিটা দেখে সত্যিই খুব ভালো লাগছে। গত দু’বছর কোভিড আমাদের থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। বড় ম্যাচও কলকাতা থেকে সরে গোয়ায় হয়েছে। ভাত ছাড়া বাঙালি আর ডার্বি ছাড়া কলকাতার ফুটবল- কখনই মেনে নেওয়া যায় না। কোভিডকালে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি। খারাপ সময় কাটিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিউ নর্ম্যালে যুবভারতীতে প্রথম বড় ম্যাচ দেখার জন্য আমিও মুখিয়ে রয়েছি। বড় ম্যাচের হিসেব কখনও খাতায় কলমে হয় না। যুবভারতীর মতো মাঠে যখন দুই দল নামবে, তখন খাতায় কলমে পিছিয়ে থাকা দলও বাজিমাত করতে পারে। বড় ম্যাচের ইউএসপি হচ্ছে সমর্থকদের গর্জন। আমার দীর্ঘ ফুটবল কেরিয়ারে যা দেখে এসেছি সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, বড় ম্যাচ সবসময় ৫০-৫০। সময় আগের চেয়ে অনেকটা পাল্টেছে। মাঠমুখী মানুষের সংখ্যাও কমেছে। বেশিরভাগই এখন মুঠোফোনে বন্দি। তবে বড় ম্যাচের উন্মাদনা আগের মতো একই রকম আছে।
আমার প্রথম বড় ম্যাচের কথা বললে ফিরে যেতে হবে ২৬ বছর আগে। ১৯৯৬ সালে ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে বড় ম্যাচে অভিষেক হয় আমার। আমাদের কোচ ছিলেন মনাদা (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য)। জীবনের প্রথম বড় ম্যাচে অবশ্য আমি জিতিনি। আবার হেরেও যাইনি। অমীমাংসিত হয়েছিল ম্যাচ। প্রথম বড় ম্যাচে মাঠে নামার আগে ভীষণ রকম টেনশনে ছিলাম। আগের ম্যাচ থেকেই সেই টেনশন শুরু হয়ে গিয়েছিল। বড় ম্যাচের দু’দিন আগের রাত থেকে ঘুম উড়ে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ করলেই খালি সমর্থকদের মুখ ভেসে উঠত। ম্যাচের আগে টেনশন। ম্যাচের পর অন্য অনুভূতি। যারা বড় ম্যাচ খেলেছে, তারাই একমাত্র বুঝতে পারবে ওই মুহূর্তটা।
ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে পরের বছরই মোহনবাগানে সই করি। সবুজ-মেরুন জার্সিতে প্রথম বড় ম্যাচের স্মৃতি খুবই খারাপ। ‘৯৭-র সেই ডায়মন্ড ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের কাছে ১-৪ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিলাম। তখন আমি দলের জুনিয়র সদস্য হওয়ায় আমাকে একটু কম বকাঝকা শুনতে হয়েছিল। তবে অমলদার ওই ডায়মন্ড সিস্টেমে কিন্তু আমরা বেশ মানিয়ে নিয়েছিলাম। ওই দিনই শুধু ক্লিক করেনি। এর পরের বড় ম্যাচটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা। ওই ডার্বিতে আমরা ইস্টবেঙ্গলকে ২-১ গোলে হারাই। জাতীয় লিগের ম্যাচ ছিল। আমাদের কাছে ওই বড় ম্যাচ জেতাটা খুব জরুরি ছিল। আমাদের কাছে ওই ডার্বিটা ছিল বদলার ম্যাচও। তাই এই জয়টা খুবই স্পেশাল। আর একটা বড় ম্যাচও আমার কেরিয়ারের সেরার তালিকায় থাকবে। মোহনবাগানে ৫ বছর খেলার পর মহীন্দ্রা ইউনাইটেড হয়ে ২০০৩ সালে ইস্টবেঙ্গলে সই করেছিলাম। মোহনবাগানের ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছিলাম। তাই লাল-হলুদ সমর্থকদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতেই হত। কলকাতা লিগের ওই বড় ম্যাচে ৩-০ জিতেছিলাম। যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম, তাতে সফল হয়েছিলাম। ওই বড় ম্যাচ জিতেই আমরা আশিয়ান কাপ খেলতে গিয়েছিলাম।
যে কোনও দলের হয়েই যখন বড় ম্যাচ খেলতে নামতাম, নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতাম। দল হারলে সব দোষ আমার ঘাড়ে এসে পড়ত। আর দল জিতলে তখন বাকিদের কৃতিত্ব। যে দলেই খেলি না কেন, ছবিটা পাল্টায়নি। মাঝমাঠে খেললেও দলের হারের দায়টা আমাকেই নিতে হত। তাই বাড়তি তাগিদ নিয়েই বড় ম্যাচে মাঠে নামতে হত। ম্যাচে অন্যরকম ফল হলেই, কোচ, কর্তাদের তিরটা সবার আগে আমার কাছে ধেয়ে আসত। শুধু ডার্বি কেন, যে ম্যাচেই মাঠে নামতাম, সেটা আমার জীবনের শেষ ম্যাচ ভেবেই মাঠে নামতাম।
মোহনবাগানে খেলার সময় বড় ম্যাচ জেতার পর ৭০-৮০ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। তখনকার সময়ে দাঁড়িয়েও অতগুলো টাকা আমার পকেটে থাকত। এগুলোই আমার কাছে সেরা প্রাপ্তি। দলকে যারা ভালোবাসত, আমাকে যারা ভালোবাসত, সবাই খেলা শেষের পর কখনও জামার পকেটে, কখনও হাতে নোটের বান্ডিল গুজে দিত। ২০০১ সালে আমার ক্যাপ্টেন্সিতে মোহনবাগান জাতীয় লিগ জেতার পর বাগুইআটি মোড়ে এক ভদ্রলোক নিজের গলা থেকে সোনার চেন খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। দু’জন সমর্থক বাগুইআটি মার্কেট থেকে নতুন জামা কিনে আমার গায়ে পরিয়ে দিলেন। ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময়ও এমন অনেক মুহূর্ত হয়েছে। সারা জীবনে ফুটবল খেলে যা রোজগার করেছি, এই মুহূর্তগুলোই আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন)