FIFA World Cup 2022: মরক্কোর ফুটবল ঝলকানিতে ভাসুক মোলেনবিকও


ব্রাসেলসের আরও একটা বিশেষত্ব চোখ টানবে। যখন-তখন পুলিশের গাড়ির বিকট সাইরেন, সেই গাড়ির ইতিউতি ছুটে যাওয়া। মরক্কো ফুটবল টিম বা ‘অ্যাটলাস লায়ন্স’-এর অপ্রতিহত গতিতে এখন ‘আরব-প্রাইড’-এর পতাকায় ঝোড়ো হাওয়া। কিন্তু কোনও বেহিসেবি, সংকীর্ণ আত্মগর্ব, তার উৎকট প্রকাশ তো বিষাক্ত চারার জন্ম দেয়, ফুল ফোটাতে পারে না।

জয়ের উচ্ছাসে মরক্কো

Image Credit source: Twitter

নীলাঞ্জন বসু

‘মোলেনবিক…। এখন যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না।’ বেলজিয়ান তরুণী এটা বলেই হনহনিয়ে হাঁটা দিলেন।
বছর তিনেক আগের শরৎ। টিনটিনের দেশে, মানে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে দ্রুত মরে আসছে বিকেল। মালবিক মেট্রো স্টেশন তখনই প্রায় শুনশান। বাইরে অতন্দ্র কমান্ডোর দল। কেন এত কার্বাইনধারী? ব্রাসেলসেই তো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদর দফতর, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট। কিন্তু শুধু কি তাই?
আর একটু পিছিয়ে যাই। ২০১৬-এর মার্চ। প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার ক্ষত ইউরোপে তখনও দগদগে। এরই মধ্যে পর পর আত্মঘাতী বিস্ফোরণ হল ব্রাসেলসে। আক্রান্ত জাভেনতেম বিমানবন্দর ও মালবিক মেট্রো স্টেশন। নেপথ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ব্রাসেলসের শহরতলি মোলেনবিকে বিস্তর ডালপালা আইএস-এর। প্যারিস হামলার চক্রী আবদেসলাম গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ছিল মোলেনবিকেই। যেখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগই আফ্রিকান, বিশেষ করে মরক্কো-সহ উত্তর আফ্রিকান। আর মালবিক স্টেশন মোলেনবিকের কাছে। আবদেসলাম তো নিজেই মরক্কান বংশোদ্ভূত। কাতার বিশ্বকাপে উত্তর আফ্রিকার এই আরব দেশটির স্বপ্নের জয়যাত্রার মধ্যেও মোলেনবিকের গায়ে সেঁটে থাকা ইউরোপের মাটিতে ‘সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর’-এর তকমাটা মোছেনি। উল্টে গরিবি, চাকরির হাহাকার, মাদক, ছিনতাইয়ের ছায়া সেখানে দিবারাত্রি।
ইউরোপের যে কোনও বড় শহর থেকে ব্রাসেলসে আসা-যাওয়া করা যায় খুব সহজে। প্যারিস, আমস্টারডাম, ফ্রাঙ্কফুর্ট, বার্লিন— গাড়ি-ট্রেনে চেপে বেলজিয়ামের রাজধানীতে পৌঁছতে লাগে কয়েক ঘণ্টা। বেলজিয়ামের এই ভৌগোলিক অবস্থান কাজে লাগায় জঙ্গিরা। উত্তর আফ্রিকা থেকে চলে আসা বহু শরণার্থী পরিবারের বাস ব্রাসেলসে। গোটা বেলজিয়ামে মরক্কানদের সংখ্যাটা ৮০ হাজারেরও বেশি। এছাড়া বাবা শ্বেতাঙ্গ-ইউরোপিয়ান বা মা উত্তর আফ্রিকান, এমন পরিবারের সংখ্যাটাও কম নয়। একটা সময় উত্তর আফ্রিকানদের নতুন প্রজন্মের অনেকেই বেলজিয়াম ছেড়ে ‘ধর্মযুদ্ধ’-এর তালিম নিতে যাচ্ছিল সিরিয়া বা ইরাকে। বঞ্চনা, অভাব, হতাশা কাজে লাগিয়ে জঙ্গিবাদে মগজধোলাই– এ এখন বহু উন্নত দেশের গভীর সমস্যা। ওপর ওপর দেখে, মিলিটারি নামিয়ে যার শিকড় ওপড়ানো কঠিন! সুযোগটা তো জঙ্গিরাই শুধু নেয় না, নেয় অতি দক্ষিণপন্থীরাও। আমরা-ওরা-র শিবির গজিয়ে ওঠে সর্বত্র।
মরক্কো চলতি বিশ্বকাপে বেলজিয়ামকে ছিটকে দেওয়ার পর ব্রাসেলস-সহ আরও কয়েকটি ইউরোপের শহরে জনতার হুল্লোড় পরিণত হয়েছিল ‘স্ট্রিট ফাইটিং’-এ। ব্যাপ্তিটা সেদিনের মতো না-হলেও স্পেনকে মাদ্রিদের বিমানে উঠিয়ে দেওয়ার পরও তেমন ছবি দেখা গিয়েছে ব্রাসেলসে। মরক্কোয় এক সময় উপনিবেশ বানানো পর্তুগিজদেরও হারানোর পর ছবিটা ঠিক কেমন দাঁড়াবে? প্রশ্নটা সহজ, উত্তর খুব কঠিন।
ফুটবল নিপীড়িত মানুষের অন্যতম হাতিয়ার ঠিকই। কিন্তু তা বেলাগাম হিংসায় ইন্ধন দিলে সুদে-আসলে কাজে লাগাবে অতি দক্ষিণপন্থী শিবির। রঙ মিলিয়ে দেওয়া নয়, ভাঙনের পথ চওড়া করে দেবে ‘বিউটিফুল গেম’, শক্তিশালী হবে ঘৃণার রাজনীতি– এর জন্য হাত গোনার প্রয়োজন নেই।
ব্রাসেলসের আরও একটা বিশেষত্ব চোখ টানবে। যখন-তখন পুলিশের গাড়ির বিকট সাইরেন, সেই গাড়ির ইতিউতি ছুটে যাওয়া। মরক্কো ফুটবল টিম বা ‘অ্যাটলাস লায়ন্স’-এর অপ্রতিহত গতিতে এখন ‘আরব-প্রাইড’-এর পতাকায় ঝোড়ো হাওয়া। কিন্তু কোনও বেহিসেবি, সংকীর্ণ আত্মগর্ব, তার উৎকট প্রকাশ তো বিষাক্ত চারার জন্ম দেয়, ফুল ফোটাতে পারে না। সে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস হোক বা মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কা, মারাকেশ বা তানজির।
কলকাতায় হলিউড ভক্তের সংখ্যা কম নয়। ১৯৪২-এ তৈরি হলিউডেরই বিখ্যাত ছবি ‘কাসাব্লাঙ্কা’। মরক্কোর শহরেরই নামে। ছবিটির বিখ্যাত গান– ‘অ্যাজ টাইসম গোজ বাই’ (As Times Goes By, Casablanca)। সময় যেভাবে যেদিকে খুশি বয়ে যাক। কিন্তু মোলেনবিক-সহ উদ্বাস্তু মরক্কানদের পাড়ায় যেন একটু আলো ছড়িয়ে দিয়ে যায় বিশ্ব-ফুটবলে ‘অ্যাটলাস লায়ন্স’-এর এই সু-সময়

Leave a Reply