হুইলচেয়ারেই শিরদাঁড়া সোজা রেখে অলিম্পিকে পদক জয় লক্ষ্য বাংলার সৌভিকের


Para Olympics: এত কষ্টের গল্পতেও কিন্তু একটা মিষ্টি পয়েন্ট আছে। সৌভিক এখন সংসার করছেন। তিনি খুঁজে পেয়েছ্ন তাঁর ভালোলাগার মানুষকে। নেট মাধ্যমেই সৌভিকের সঙ্গে আলাপ তাঁর প্রেমিকার। এখন সংসার জমজমাট। সৌভিককে নিয়ে লিখলেন সুমন মহাপাত্র।

Image Credit source: OWN Arrangement

শহর কলকাতা। ব্যস্ত চিংড়িহাটা মোড়। ভিন্ন গন্তব্যে কত মানুষ ছুটছে। আমরা কতজনেরই বা খবর রাখি! ট্রামের ঘণ্টা, গতিশীল বারাসত-বারুইপুরের হর্নের কাছে চাপা পড়ে যায় কত জীবনের গল্প, কত লড়াইয়ের গল্প। খেলা বলতে আমরা বুঝি ক্রিকেট-ফুটবল, খুব বেশি হলে দাবা, কাবাডি কিংবা হকি। আর বাঙালির খেলোয়াড় বলতে ওই সৌরভ গাঙ্গুলি। হ্যাঁ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ঝুলন গোস্বামী শুনলে একটু গর্ব বোধ করেন। যদিও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। আগে প্রতিভার প্রচারে যে অদ্ভূত একটা বেড়া ছিল। ১০ এমবিপিএস প্রতি সেকেন্ডের গতিতে তা পিসি সরকারের ওই ট্রেনের মতো অনেকক্ষেত্রেই ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। তাই তো হঠাৎ নাম উঠে আসছে, নাম না জানা কোনও গ্রামের এক প্রতিভার। যাই হোক আজকে যাকে নিয়ে কথা হবে, তাঁর জীবনের সঙ্গে অসহায়তা আর লড়াই যেন সমান্তরাল। সৌভিক, সৌভিক কর। না তাঁকে খুব একটা কেউ চেনে না। চেনার কথাও নয়। খাস কলকাতায় যে এরকম একটা চরিত্র রয়েছে, জানলে কোনও পরিচালক হয়তো একটা বায়োপিক বানানোর পরিকল্পনা করতেই পারেন। বিস্তারিত রইল TV9Bangla Sports-এর এই প্রতিবেদনে।

চলুন ব্যস্ত চিংড়িহাটার মোড়ে আর একবার ফিরে যাই। সেখান থেকে বাইপাস ধরে এগোলেই স্পোর্টস অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া। এখানেই হুইল চেয়ারে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে সৌভিক। সল্টলেকে বাড়ি সৌভিকের। বাবা সরকারি কর্মচারী। মধ্যবিত্ত সুখী পরিবারের ছেলে হিসেবে সৌভিকের পরিচয় দেওয়াই যেত। কিন্তু তাঁর জীবনটা বড্ড অন্যরকম। ১১ বছর বয়সেই নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারিয়েছেন সৌভিক। গল্পটা এখানে শুরু। আর তারপর বাঁকে বাঁকে শুধুই ধাক্কা।

ক্লাস সিক্স, দোলনা থেকে পড়ে শিরদাঁড়ায় গুরুতর চোট লাগে সৌভিকের। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা চলে যায়। তবে এ যাত্রায় রক্ষে হয়। চেন্নাইতে অস্ত্রোপচারের পর স্বাভাবিক জীবনে ফেরে সৌভিক। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস। বছর ছয়েক ঘুরতে না ঘুরতেই আবার বাথরুমে পড়ে যায় সে। আঘাতের ওপর ফের আঘাত। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের যে ছেলেটা স্পিন বল করে ধোনির টিমে নাম লেখাতে চায়, হঠাৎ করে তাঁর জীবন এক্কেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। হিপ জয়েন্টে বড় চোট। যেহেতু আগে মেরুদণ্ডের এত বড় অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাই হিপ রিপ্লেসমেন্ট আর সম্ভব নয়। আবারও উঠে দাঁড়ানোর শক্তি শেষ। জীবনটা বন্দি হয়ে গেল হুইলচেয়ারে। পড়াশোনার ল্যাটা চুকে গেল। ২০১৭-১৮ পর্যন্ত জীবনের প্রত্যেকটা দিন যেন এক বছর সমান। এতটাই কষ্ট আর শ্লথ যে জোরে ঠেললেও এগোচ্ছে না। অবসাদ ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাঁকে। ভাঙা শিরদাঁড়া যেন পিঠে ছুরির মতো বিঁধছে। সৌভিক রোজ ভাবছে, জীবনটা কি এখানেই আটকে যাবে?

তবে স্পোর্টসম্যান সৌভিকের একটা অদম্য জেদ ছিল। সেই জেদের জোরেই ২০২০ সালে দেওয়ালে ঠেকে য়াওয়া পিঠটাকে ঝাঁকিয়ে তুলল সে। যেন চেঁচিয়ে বলল এই জীবন আর না। ততদিনে প্যারা অলিম্পিকসে ভারতের ঝুলিতে ১৯ খানা পদক। দেশের প্রধানমন্ত্রী পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন অলিম্পিয়ানদের। সৌভিকের মনের ভেতরের ওই স্পিন বোলারটা একটা গুগলি ফেলতে চাইল। যোগাযোগ হল বেঙ্গল প্যারা অলিম্পিকস অ্যাসোসিয়েশনের কর্ণধার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরে সটান হাজির অফিসে। আসলে ওই কিছু করে দেখানোর খিদেটা সৌভিককে তখন তাড়াচ্ছে। কিন্তু সৌভিক খেলবে কী? বাংলায় তো প্যারা গেমস অত জনপ্রিয় নয়। চোখে চশমা, সুঠাম চেহারার ছেলেটা সেদিন হাতে তুলে নিতে চেয়েছিল ভারী বার। পারেনি। শুরুতে মনে হয়েছিল স্পিন বোলার আবার এসব পারে নাকি? কিন্তু ওই যে জেদ সব পারে। আসতে আসতে রোজনামচায় এল জিম। স্পিন বোলার আসতে আসতে হয়ে উঠল পাওয়ার লিফ্টার। সৌভিক এখন জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়। ঝুলিতে চকচক করছে স্বর্ণপদক।

এখানেও টুইস্ট। সুদিন দীর্ঘ হয়নি সৌভিকের। যে বাবা শিল্ডের মতো বারবার গার্ড করে গিয়েছেন তাঁকে। সেই চাদরটাই ২০২২-এ আর থাকল না। তাঁকে ছেড়ে চলে যান বাবা, চলে যায় একটা স্থায়ী ভরসা। তারপরেও লড়াই চলছে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে পদক আনার জন্য ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছে সৌভিক।

এই এত কষ্টের গল্পতেও কিন্তু একটা মিষ্টি পয়েন্ট আছে। সৌভিক এখন সংসার করছেন। তিনি খুঁজে পেয়েছ্ন তাঁর ভালোলাগার মানুষকে। নেট মাধ্যমেই সৌভিকের সঙ্গে আলাপ তাঁর প্রেমিকার। এখন সংসার জমজমাট। সৌভিকের হুইল চেয়ারের স্টিয়ারিংটা এখন তাঁর হাতেই, আর জীবনটাও। সৌভিকের কথায়, “আমি ওকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি তুই আমাকে কেন পছন্দ করিস? ও বলেছে তুই খুব ট্যালেন্টেড তাই। কীসের ট্যালেন্ট আমি বলতে পারব না। ও হ্যাঁ, আমি কবিতা লিখি, ওগুলো ওর পছন্দের।”

সৌভিকের ট্যালেন্টের সেই ভক্ত না হয় আর কিছুদিন আড়ালেই থাকুক। আর সৌভিক এই জেদটার জোরে আরও অনেক অনেক পদক আনুক। ওর কথাতেই, “বাঁচতে গেলে একটা রেকগনিশন তো লাগে। আর এখন স্পোর্টস সবচেয়ে বেশি সম্মান দেয়। তাই খেলে যাব।”

Leave a Reply