মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য: লেখার শুরুতেই বলতে হচ্ছে যে ইস্টবেঙ্গলকে আমি ছোট থেকে দেখে এসেছি। যে টিমের মানসিকতা লড়াইয়ের, সেই ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে শনিবারের লাল-হলুদ জার্সি পরা ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের তফাত আকাশ-পাতাল। আরও ভালোভাবে বললে এই ইস্টবেঙ্গলকে আমি চিনতে পারছি না। একটা নয়, দুটো নয় একেবারে পাঁচটা ম্যাচে হার! তারমধ্যে একটা বড় ম্যাচ!
আমাদের সময়ের কথা যদি বলি, একটা ম্যাচে হারলে পরের ম্যাচে উজাড় করে দিয়ে জয় তুলে আনতে চেষ্টা করতাম। মনের মধ্যে একটা জেদ থাকত। জ্বালা থাকত। মনে হত কতক্ষণে পরের ম্যাচটা জিতে সেই জ্বালার উপশম ঘটাব। এটাই ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু এখন? কি অজুহাত দেবে-দল ভালো নয়? গতবারের আইএসএলের সেরা দুই ফুটবলার মাদিহ তালাল আর দিয়ামান্তাকোসকে তুলে এনেছেন কর্তারা। রক্ষণে আনা হয়েছে আনোয়ার আলির মত দেশের সেরা ডিফেন্ডারকে। তাহলেও কেন পাঁচটি ম্যাচে হার? এই প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? আমি মনে করি এই উত্তর ফুটবলারদেরই মাঠেই দিতে হবে।
আমাদের সময় একটা ম্যাচ হারলে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় বসে পড়তাম। কীভাবে পরের ম্যাচটা জিতব। একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে। ’৮৫ সালে ইস্টবেঙ্গল দারুণ দল গড়েছিল। ভাস্কর, বলাই, তরুণ, অলোক, সুদীপ, বিকাশ, জামশেদ, কৃষাণু, বিশ্বজিৎ। সঙ্গে আমি। আরও অনেকে ছিল। কোচ প্রদীপদা। সে বছর বেঙ্গালুরুতে ফেডারেশন কাপ হচ্ছিল। আমরা গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলো জিতছিলাম। তবে এত ভালো দল নিয়ে কেন ভালো খেলছিলাম না তা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছিল কলকাতার কাগজগুলোতে। আমরা প্রতিদিন রাতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজগুলো হাতে পেতাম। আমাদের নিয়ে সমালোচনাগুলো পড়তাম আর মনে মনে রাগ করতাম। এভাবেই ফাইনালে চলে গেলাম।
সামনে মোহনবাগান।
ফাইনালের ঠিক আগের দিন টিম মিটিংয়ে প্রদীপদা কথা বলতে শুরু করলেই আমি থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ‘প্রদীপদা আপনি ম্যাচের পর বলবেন।’ সেদিন প্রদীপদাকে থামিয়ে দিয়ে আমি কুড়ি মিনিট যে কথাগুলো সহ ফুটবলারদের বলেছিলাম তা সবই ছিল ওই সমালোচনার কথা। সেই সব কথা আজ আর প্রকাশ্যে বলতে পারব না। অলোকদের বলেছিলাম, ‘এর জবাব মাঠে দিতে হবে।’ ফাইনালে মাঠে সবাই জবাব দিয়েছিল। ম্যাচটা জিতে কলকাতা ফিরেছিলাম। সেই মোটিভেট করার মতো ফুটবলার খুঁজছি এই ইস্টবেঙ্গলে। কিন্তু কোথায়? একজন নেতা খুঁজে পাচ্ছি না এই টিমে, যে এই কঠিন সময়ে এসে বলবে- চলো এই সমালোচনার জবাব দিতেই হবে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে- এটাই কি পেশাদারিত্ব? হেরে গেলাম আর ভুলে গেলাম সবকিছু। জ্বালা হয় না মনে? ইস্টবেঙ্গলের থেকেও অনেক কম বাজেটের দল হায়দরাবাদ এফসিও একটা পয়েন্ট পেয়ে লিগ টেবিলে ক্লেটনদের উপরে রয়েছে।
পাঁচটা ম্যাচ হারের ফলে দলটার মানসিক অবস্থা যথেষ্টই খারাপ। আমি যদি এই দলের দায়িত্বে থাকতাম, তাহলে প্রথমেই ফোকাস করতাম প্রথম পয়েন্ট আগে তুলতে আনার দিকে। পরবর্তী ম্যাচে ডিফেন্সকে আরও আঁটসাঁট করে গোল খাওয়াটা আটকাতাম। গোল খাওয়া আটকে দিতে পারলে এক পয়েন্ট আসা নিশ্চিত । এই এক পয়েন্টটা ফুটবলারদের মানসিক বল বাড়াতে অনেকটাই সহায়তা করবে। এই গোল খাওয়া রোগটা শুধু এবছরের নয়। গতবারও ইস্টবেঙ্গল কিন্তু গোল করছিল তবে গোল ধরে রাখতে পারছিল না। গোল খাওয়ার রোগটা না সারালে এই সমস্যা থেকে বেরনো যাবে না।
দ্বিতীয়ত দলের ফুটবলারদের একাত্মতা বাড়াতে হবে। ম্যাচের মধ্যে সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। একাত্মতা বাড়লে তখন দেখবেন, অন্যের ভুলটা নিজের ভুল মনে হবে। তখন সহ খেলোয়াড় কোনও ভুল করলে পাশের খেলোয়াড়টি সেই ভুলকে ঢাকতে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে। এটাকেই বলে দলগত লড়াই। এই লড়াইটার অভাব দেখা দিচ্ছে ইস্টবেঙ্গলের খেলায়। আমি কোচ হলে এই বিষয়গুলোই তুলে ধরতাম ফুটবলারদের সামনে। যদি এই দলের সিনিয়র ফুটবলার হতাম, নিজেই এগিয়ে গিয়ে সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসতাম। আসলে এই দলে প্রকৃত নেতার দরকার। শুধু অধিনায়ক নয়, অন্য সিনিয়র ফুটবলারদেরও দায়িত্ব নিয়ে মাঠে জবাবটা দিতে হবে।
এবার আসি আনোয়ার আলির প্রসঙ্গ। অনেকেই বলছেন, আনোয়ারের মাঠের বাইরের চাপ খেলায় প্রভাব ফেলছে। আমি বলি কি, দেশের হয়ে খেলে আসা ডিফেন্ডার। যে কলকাতায় খেলে ফেলেছে। সে জানে এখানে চাপ নিয়েই খেলতে হয়। আমি মনে করি না বাইরের চাপ এসে পড়ছে আনোয়ারের খেলার উপর। আমি জানি একজন পেশাদার খেলোয়াড়কে এই চাপ নিয়েই খেলতে হবে। আনোয়ারের থেকে যে নেতৃত্ব চায় দল সেই প্রত্যাশা এখনও পূরণ করতে পারেনি আনোয়ার। ওকে ফর্মে ফিরতেই হবে। কিভাবে ফিরবে সেটা ওই জানে। তবে আমি জানি ইস্টবেঙ্গল এমন একটা দল যারা প্রতি ম্যাচে জেতার জন্যই নামে। সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে সমালোচনার স্রোত বয়ে যায়। সেই সমালোচনাও কি গায়ে লাগছে না ক্লেটনদের?