আগামীর মহাতারকা থেকে কক্ষচ্যুত নক্ষত্র, কেন বিস্মৃতির অতলে শচীনকে চ্যালেঞ্জে ফেলা কাম্বলি?


বিশ্বদীপ দে: হঠাৎই তিনি ফিরে এসেছেন জনমানসে। বিনোদ গণপতি কাম্বলি। একসময় স্টাইলিশ ব্যাটিংয়ে যিনি মন কাড়তেন সকলের, খোদ ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড স্পর্শ করে গড়েছিলেন অনন্য নজির… সেই সুপারস্টার আজ অতীতের ক্ষীণ ছায়া মাত্র। বিশ্বাসই হয় না টাকমাথা, একমুখ পাকা গোঁফদাড়ির প্রবীণ মানুষটি একই লোক! যাঁরা সেই পুরনো দিনে বাইশ গজে কাম্বলির ‘ধুঁয়াধার বল্লেবাজি’ দেখেছেন, তাঁদের কাছে আচমকাই কাম্বলিকে দেখতে পাওয়া যেন অতীতের দরজা হুট করে খুলে যাওয়া। অথচ হিসেব মিলছে না। কাম্বলি বলতেই চলে আসে তাঁর বাল্যবন্ধু শচীন তেণ্ডুলকরের নাম। যাঁর ঝকঝকে শরীরী ভাষা দেখলে বোঝা দুষ্কর বয়স পেরিয়েছে পঞ্চাশ! সেখানে কাম্বলির বয়সের উপরে জমেছে আরও বয়সের আস্তরণ। মনেই হয় না সবে মাত্র পঞ্চাশের কোঠায় প্রবেশ করেছেন!

একথা সকলেই জানে, ‘দেহ পট সনে নট, সকলই হারায়।’ কিন্তু ততটা সময়ও কি পেরিয়েছে? আসলে বয়সের ভারের চেয়েও কাম্বলির অসুস্থতা অনেক বেশি ভারী হয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। অথচ যদি দ্রুত টাইম মেশিনে চেপে গত শতাব্দীর নয়ের দশকে পৌঁছে যাওয়া যায় তাহলে দেখা মিলবে এমন এক ক্রিকেটারের যিনি তাঁর ততদিনে বিশ্বখ্যাত হয়ে পড়া বন্ধুটিকেও চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছেন। ২১ বছর ৫৪ দিন বয়সে পরপর দুটি টেস্টে হাঁকিয়েছেন ডবল সেঞ্চুরি। প্রথমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২২৪। তারপর জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ২২৭। ১৯৯৩ সাল সেটা। সবে অর্থনৈতিক উদারতাবাদের পথে হাঁটা শুরু করেছে দেশ। চারপাশে পরিবর্তনের হাওয়া। বিদেশি পণ্যেরা ঢুকতে শুরু করেছে দেশীয় বাজারে। দূরদর্শনের পর্দা থেকে ইএসপিএনের মতো বেসরকারি চ্যানেলে এরপর শুরু হবে ক্রিকেটের দুরন্ত সম্প্রচার। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘দাম’ বাড়তে শুরু করেছে। আর সেই নতুন যুগের মশাল যাঁর হাতে তিনি শচীন তেণ্ডুলকর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র বছর তিনেক কাটিয়েই তিনি নিজেকে প্রমাণ করে দিয়েছেন। কপিল দেবের মতো তারকা তখনও অবসর নেননি। তবু মিস্টার ইন্ডিয়ান ক্রিকেট হয়ে উঠেছেন শচীনই। এহেন মহাতারকাকে কড়া চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসেছিলেন কাম্বলি। কেননা শচীনের ডবল সেঞ্চুরি পেতে তখনও অনেক সময় বাকি। টেস্টেই কেবল নয়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও দ্বিশতরান তাঁর অধরা। ওয়ানডে সেঞ্চুরিও হয়নি। অনেকেই বলতে শুরু করল এই ছেলেটা শচীনকেও ছাপিয়ে যাবে।

আজকের বিনোদ কাম্বলি। ছবি: পিটিআই

এর কয়েক বছর আগে ১৯৮৮ সালের হ্যারিস শিল্ডের সেমিফাইনালে ৬৬৪ রানের জুটি গড়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল সারদাশ্রম বিদ্যা মন্দিরের দুই কিশোর। তাদের একজন ৩২৬। অন্যজন ৩৪৯। হ্যাঁ, সেই বিশ্বরেকর্ডও কাম্বলির অবদানই বেশি ছিল। তবু শেষপর্যন্ত শচীন বেশি আলো কেড়ে নেন কেননা সেবার হ্যারিস শিল্ডে শচীনের রান ছিল অপরাজিত ২১, ১২৫, অপরাজিত ২০৭, অপরাজিত ৩২৯ এবং অপরাজিত ৩৪৬। সব মিলিয়ে পাঁচ ইনিংসে ১০২৮ রান। গড়ও ১০২৮-ই। কেননা মাত্র একবারই আউট হয়েছিলেন। এরপর বছরখানেকের মধ্যে ঘরোয়া ক্রিকেটে অসামান্য পারফরম্যান্সের পর পাকিস্তান সফরে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন ‘পোস্টার বয়’ হয়ে গিয়েছিলেন শচীন। কিন্তু কাম্বলি? তাঁর রনজি কেরিয়ার শুরু হয় ছক্কা হাঁকিয়ে! ওয়ানডে কেরিয়ার শুরু ১৯৯১ সালে। টেস্ট অভিষেক ১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আর জীবনের তৃতীয় টেস্টেই তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল সেই ২২৪। পরের টেস্ট জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে, ২২৭। এরপর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টেস্ট সিরিজে এল জোড়া শতরান (১২৫ ও ১২০)। তিনটি ভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে পরপর তিনটি শতরান করার সেই নজির আর কেউ ছুঁতে পারেনি। আজও। এখানেই শেষ নয়। ১৪ টেস্ট ইনিংসে হাজার রান। সেটাও ভারতীয় হিসেবে রেকর্ড।

সেই সময় কাম্বলি এক ঝলমলে তরুণ। যিনি বিখ্যাত বন্ধুকেও ছায়াচ্ছন্ন করতে শুরু করেছে। এরপরই শুরু ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ প্রবাদটির মিথ্যে হতে থাকা। কেউ ভেবেছিল, এমন ঝকঝকে কেরিয়ার শুরুর পরও মাত্র ২৩ বছর বয়সেই জীবনের শেষ টেস্ট খেলে ফেলবেন কাম্বলি! ওয়ানডে কেরিয়ার অবশ্য টিকবে ২০০০ সাল পর্যন্ত. দুটি বিশ্বকাপও খেলা হবে। কিন্তু সব মিলিয়ে শুরুর সেই জৌলুস যেন গায়েব হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যখন দর্শকের রোষে খেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন কাম্বলি। এ দৃশ্য অনেকেরই মনে রয়েছে। কিন্তু সেদিন কারওই বিশ্বাস হয়নি, খেলা পুরো হলে কাম্বলি ম্যাচটা জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে পারতেন। কেননা ততদিনে কাম্বলির গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করেছে হু হু করে।

Maharashtra government approves a memorial for Sachin Tendulkar's coach Ramakant Achrekar in Shivaji Park
গুরু আচরেকরের সবচেয়ে খ্যাতিমান ছাত্রের দ্যুতিতে ঢাকা পড়েছেন কাম্বলি।

কাট টু ২০২৪। ভাইরাল এক ভিডিওয় সকলে দেখলেন শচীন ও কাম্বলির মুখোমুখি হওয়া। শরীরী ভাষায় এক আশ্চর্য শৈথিল্য ও অস্বাভাবিকতা। গান গাইবার সময় দেখা গেল, কণ্ঠস্বর কেঁপে যাচ্ছে অসুখের ভারে। দেখতে দেখতে অনেকেরই মনে প্রশ্নটা জন্ম নিল, কেন এমন হল? একথা সবাই জানে, কোর্টনি ওয়ালস ভারতে সিরিজ খেলতে এসে দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন শর্ট পিচ বলে কাম্বলির কী নিদারুণ দুর্বলতা রয়েছে! যে দুর্বলতা কাম্বলি আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু এই টেকনিক্যাল কারণটিই কি সব? শেন ওয়ার্নের গালাগালি সহ্য করতে না পেরে যিনি এক ওভারে ২২ রান তুলেছিলেন, সেই ক্রিকেটারের প্রতিভা তো নেহাত কম ছিল না। অনুশীলনে সেই ছিদ্র ঢেকে দেওয়া যেত না? আসলে মাঠের বাইরে ডিস্কোর নৈশ জীবন এবং হইহুল্লোড়ের ভিতরে শরীরটার ক্ষতি হতে থেকেছে। নষ্ট হয়েছে ফিটনেস। ধ্বংস হয়েছে ফোকাসের নিবিড়তা। সারা জীবনে জড়িয়েছেন অজস্র আইনি ঝামেলায়। নিজেরই আবাসনে গুন্ডামি, মদ খেয়ে গাড়ি চালানো এমনকী পরিচারিকাকে নিগ্রহের অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে। ২০২২ সালে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে গ্রেপ্তারও হতে হয়েছিল। বিয়ে টেকেনি। দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। ততদিনে তাঁর আর্থিক দুরবস্থার কথা সর্বজনবিদিত হয়ে গিয়েছে। ক্রিকেট তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছিল। তিনি ধরে রাখতে পারেননি। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাওয়া বালির মতো ঝরে গিয়েছে সাফল্যের সব অণু-পরমাণু!

কাম্বলির জীবনের যে দিন গেছে ভেসে।

কেরিয়ারের ১৭টি টেস্টে ৫৪.২ গড় কাম্বলির। হ্যাঁ, শচীনের থেকেও বেশি! কিন্তু প্রথম ইনিংসে যেখানে তাঁর গড় ৬৯.১৩, সেখানে দ্বিতীয় ইনিংসে তা মাত্র ৯.৪! ফারাক ৫৯.৭৩-এর। এই পরিসংখ্যানই বুঝিয়ে দেয় ধারাবাহিকতার অবস্থাটা। দ্বিতীয় ইনিংসের মতো চরম পরীক্ষায় পড়তেই রানের খরার মুখে পড়তে হয়েছে। আসলে খ্যাতি গিলে ফেলেছিল কাম্বলিকে। নিজের প্রতিভা ও সেই প্রতিভার প্রাপ্তি কাম্বলি হজম করতে পারেননি। দারিদ্র দেখেছিলেন শৈশবে। বড় হয়ে স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে হয়তো ফোকাস নড়ে গিয়েছিল। আর তাই আজকের প্রজন্মের কাছে তিনি এক অসুস্থ বুড়োটে মানুষ মাত্র। লিজেন্ডদের লিগেও নাকি শচীন ফিটনেস নিয়ে ভাবিত থাকেন, বেশি রাত করে ঘুমোতে যান না। অন্যদিকে কাম্বলির হৃদযন্ত্র কাহিল হয়ে পড়েছে ক্রমশ। ফলে বারবার সংক্রমণে ভুগতে হয়েছে। হচ্ছে। তিরিশ বছরে পৃথিবী আসলে অনেক দূরে সরে গেছে। পুরনো পৃথিবীর অনেক কিছুর মতোই কাম্বলিও ছোটবেলার খাতায় লাগানো এক জলছবি আজ। জলের মতো বয়ে গিয়েছে যে হারানো পৃথিবী। যে পৃথিবীর গান আজও ভেসে আছে হারানো সময়ের অন্দরে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ




Leave a Reply